Social Icons

শ্বাসত গ্রাম বাংলার কিছু চিরায়ত বাঙ্গালিয়ানার নিদর্শন পহেলা বৈশাখ- ১৪২২



বৈশাখ আজ জাগ্রত দ্বারে। রাত পেরিয়ে কাল ভোরের আলো ফুটে উঠলেই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে নতুন বছরের বারতা। পহেলা বৈশাখ ১৪২২। বৈশাখ, নতুন বছর, নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে মুছে যাক সকল বেদনা ও গ্লানি। ধুয়ে যাক সব পাপ, তাপ, ব্যাথা।আগামী বছরের প্রতিটি মূহুর্ত, ক্ষন ভরে উঠুক সাফল্যে আর আনন্দে! নুতন বছরটিকে, বাংলা ১৪২২ কে বরণ করে নেই বাঙ্গালীর সেই শ্বাসত গানে।

এসো হে বৈশাখ এসো এসো
তাপস নিশ্বাস বায়ে, মূমুর্ষকে দাও উড়ায়ে ...
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক !!
এসো এসো...... এসো হে বৈশাখ এসো এসো........
পহেলা বৈশাখ ও চৈত্র সংক্রান্তি-
প্রায় সকল দেশে, সকল জাতির মাঝেই আছে নতুন বর্ষবরণের সংস্কৃতি। আপাতদৃষ্টিতে বাঙ্গালীর বর্ষবরণ উৎসব বৈশাখের প্রথম দিনটিতে করা হয় মনে হলেও আসলে তা নয়, চৈত্রের শেষদিনটিতে চৈত্রসংক্রান্তির মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাঙ্গালীর প্রাণের এ উৎসবটি। গ্রামাঞ্চলে বছরের এই শেষ দিনে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসবে পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে, নতুন বছরের জন্য শুভকামনা জানানো হয়, সুচনা হয় নতুন ভোরের নতুন সূর্য্যদয়ের সাথে সাথে নতুন বছরটির। চৈত্র সংক্রান্তিতে রাতভর গান বাজনা, পালাগানে ভরে ওঠে বাংলার গ্রাম, গঞ্জ, বন্দরগুলো। ইদানিং শহরেও এই চৈত্র সংক্রান্তি উৎসবের আয়োজন হয়। শহরের মানুষগুলোও নাচে গানে আর উৎসবে বিদায় জানায় বছরের শেষদিনটির শেষ মুহুর্তটিকে। চৈত্রসংক্রান্তির রাত পেরুলেই নতুন ভোরের সূর্য্যদয়ের সাথে সাথে সুচনা হয় বাঙ্গালীর নতুন বছরের। ১৯৬৫ হতে আজ পর্যন্ত রমনার বটমূলে রবিঠাকুরের এসো হে বৈশাখ গানটি গেয়ে ছায়ানটের পক্ষ থেকে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় ঢাকাবাসী। এছাড়াও বাংলাদেশের শহর, নগর, গ্রামে দিনভর চলে বৈশাখী মেলা ও নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বাংলা বছরের জন্মাতিহাস, বাংলা মাসগুলির নামাকরণ ও বাংলা সপ্তাহের দিনগুলির আদিকথা-
শোনা যায় মোগল সাম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন সম্রাট আকবর । তিনি সিংহাসনে বসার পরই আগ্রা ও দিল্লি দখল করে নেন আদিল শাহ শূরের সেনাপতি হিমু। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে সেনাপতি হিমু সম্রাট আকবরের কাছে পরাজিত হলে তার এই বিজয় উদযাপন করতে এবং আরও সুবিধাজনক ভাবে খাজনা আদায় করতে সম্রাট আকবর ইলাহী সন চালু করেন।মোঘল আমলে রাজারা খাজনা আদায় করতেন চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী। কিন্তু চান্দ্রবর্ষ প্রতিবছর ১১ দিন করে এগিয়ে যেতো আর কৃষকের খাজনা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়তো।
বাদশাহ আকবর বিজ্ঞানভিত্তিক ও কার্যকর পদ্ধতিতে বছরের হিসাব রাখার কথা ভাবছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি দায়িত্ব দেন সে সময়ের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোর্তিবিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে। তার সহযোগীতায় ১৫৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ সম্রাট আকবর ‘ইলাহী সন’ নামে নতুন এক সন চালু হয়। সে সময়ের কৃষকদের কাছে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়। পরে এটি ‘বঙ্গাব্দ’ নামেই পরিচিতি পায়। নতুন এই সালটি আকবরের রাজত্বের ২৯তম বর্ষে চালু হলেও তা গণনা আরম্ভ হয় ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে কারণ ওই দিনেই দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে তিনি হিমুকে পরাজিত করেছিলেন।
বাংলা মাসগুলির নামকরণ করা হয় বিভিন্ন নক্ষত্রের নামে। বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বিন - অশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রাইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্গুন, এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। তবে অগ্রহায়ণ মাসের নামের আরেকটি ব্যাখ্যা আছে। অগ্র অর্থ প্রথম, হায়ণ অর্থ বর্ষ বা ধান। আগে এই মাস থেকেই বছর গণনা আরম্ভ হতো বা এই সময়ে প্রধান ফসল ধান কাটা হতো। আর তাই এই মাসের নাম হয় অগ্রহায়ণ।
সবচেয়ে মজার আর আশ্চর্য্য ব্যাপারটা হলো এখন মাত্র সাতটা দিনে হয় এক সপ্তাহ আর এই সাতদিনের নাম প্রতি সপ্তাহে ঘুরে ফিরে আসে। আকবরের সময় মাসের প্রত্যেকটি দিনের জন্য আলাদা আলাদা নাম ছিল। ভাবা যায়! এ কথা শুনে এখন মাথা ঘুরাচ্ছে বটে তবে সম্রাট আকবরের আমলে সেটাই ছিলো নিয়ম। এত ঝামেলা, এতো কষ্ট দেখে সম্রাট শাহজাহান একজন বিদেশি পণ্ডিতের সাহায্য নিয়ে সাপ্তাহিক পদ্ধতিতে দিনের নামকরণ পদ্ধতি চালু করেন। এ কারনেই ইংরেজি দিনের নামের সাথে বাংলা দিনের বা বারের নামের মিল পাওয়া যায়। যেমন সানডে (ঝঁহফধু) হলো রবিবার। ইংরেজি ঝঁহ (সান) অর্থ সূর্য্য বা রবি।
বৈশাখ ও রমনার বটমূল-
তখন ব্রিটিশ আমল। সবার মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী চেতনা গড়ে উঠছে। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। এরপর আবার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবর পাওয়া যায় ১৯৩৮ সালে। তবে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। বাংলা বর্ষপঞ্জি বা বঙ্গাব্দ বাঙালির নিজস্ব সাল হলেও, সারা বিশ্বের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখতে বাংলাদেশের সব জায়গাতেই খ্রিষ্টীয় সন ব্যবহার করা হয়। ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন থেকে আমরা বাংলা একাডেমীর সুপারিশ করা পঞ্জিকা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়।
স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের কথা। সে সময়ের পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার প্রতিবাদে ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ বা ১৯৬৫ সালে রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদাযাপনের আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। রবি ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানায় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। ১৯৭২ সালের পর থেকেই মূলত এটি জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৯৮০ সালে প্রচলন হয় বৈশাখী শোভাযাত্রার। এছাড়া এইদিনে বাংলা একাডেমীসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানই উদযাপন করে পহেলা বৈশাখ।
বৈশাখীমেলা -
পহেলা বৈশাখে নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সাথে সাথে বৈশাখী মেলা যেন অপরিহার্য্য। ঢাকায় বছরের প্রথম সূর্য্যদয়ের সাথে সাথে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয় রমনার বটমূলে। ছায়ানটের শিল্পীরা বৈশাখের আগমনী গান গেয়ে স্বাগত জানান নববর্ষকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলায় একই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-ছাত্ররা মিলে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এদিন শহীদ মিনার, টি.এস.সি এবং চারুকলা সহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে।
বৈশাখী মেলায় পাওয়া যায় কারূপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব ধরণের হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী। এ ছাড়া বাচ্চাদের খেলনা, মাটি, কাঠ, পুঁতির গয়না রকমারি লোকজ খাদ্যসামগ্রী, চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা ও বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে মেলায়। বাঙ্গালীরা বছরের এই প্রথম দিনে খায় পান্তা ইলিশ। শুধু খাওয়া দাওয়াই নয়, এসব মেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগীতি ও লোকনৃত্য পরিবেশন করা হয়। সেখানে পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গান তো থাকেই, থাকে যাত্রাপালার আয়োজনও, থাকে পুতুল নাচ, নাগরদোলা, বায়োস্কোপ, সাপের খেলা। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয় বাংলাদেশের প্রতিটি শহর গ্রাম, বন্দরে প্রতিটি মানুষ মেতে ওঠে আনন্দ যজ্ঞে।
পোষাকে সাদা ও লালের আভিজাত্য-
পহেলা বৈশাখে বাঙ্গালীর সাজে প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে আরামদায়ক সুতী কাপড়ে লাল সাদাকেই প্রাধন্য দেওয়া হয়। রেশমী চুড়ির রিনঝিনি আর আলতা টিপে বাঙ্গালী ললনাদের কলহাস্যে মুখরিত হয় চারিদিক। গ্রামে গঞ্জে কৃষক কিষানীকে উপহার দেয় নতুন ডুরে শাড়ী।
হালখাতা অনুষ্ঠান
নতুন বছরের প্রথমদিনটিতে ব্যাবসায়ীদের মাঝে হালখাতা খোলা এক বহু প্রচলিত রীতি। সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই সবাইকে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল প্রকার খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এরপর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের দিন ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়েই বর্তমানে হালখাতা অনুষ্ঠান। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে মূলত একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়। হালখাতা বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। নতুন বছরের সকল হিসাব-নিকাশ নতুন করে শুরু করা হয় এই হালখাতায়। শহর কিংবা গ্রাম বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব-নিকাশের বই বন্ধ করে নতুন বছরের জন্যে হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে। বিশেষ করে বড় বড় সোনার গহনার দোকানে গেলেই পেট পুরে মিষ্টি খাওয়া যায়।
শ্বাসত গ্রাম বাংলার কিছু চিরায়ত বাঙ্গালিয়ানার নিদর্শন যা আমাদের প্রতিটি বাঙ্গালীর বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের শহর বা গ্রামঞ্চল ভেদে প্রতিটি নাগরিকের জানা বিশেষ প্রয়োজন।


ও ধান ভানিরে ঢেকিতে পাড় দিয়া- আমাদের ঢেকি শিল্প-
গ্রাম বাংলার বৌ ঝিদের সেই ধান চাল ভাঙ্গার ঢেকিতে পাড় দেওয়ার ছবি যেন ফুটে ওঠে এ গানটিতে।ঢেকি আমাদের এই বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যেরই একটি অংশ। আজকাল গ্রামের বাড়িগুলিতেও খুব কম পরিমান ঢেকিই চোখে পড়ে অথচ একদিন ঢেকি ছাড়া একটি বাড়িও কল্পনা করা কঠিন ছিলো। চাল ডাল মসলা ঢেকিতে ভানতো বাড়ির বৌ ঝিয়েরা। আজ ঢেকিতে ছাটা শস্যের বদলে এসেছে মিলে ছাটা চাল, ডাল মসলা। তাই আর আজকাল গ্রামের বাড়িগুলোতে ঢেকিতে পাড় দেবার ধুপধাপ শব্দও শোনা যায়না । শোনা যায়না সেই গান- ও ধান ভানিরে ঢেকিতে পাড় দিয়া, ঢেকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া। তবে ঢেকি ছাটা চালের কদর এখনও কমেনি কারন ঢেকি ছাটা চালের উপরের আবরন বা খোসা অন্নু থাকে যাতে প্রচুর পরিমান ভিটামিন রয়েছে। ঢেকি চালাতে সাধারনত দুজন লোকের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সাধারনত মহিলারাই চালায় ঢেকি। একজন থাকেন বড় কাঠের সাথে লাগানো অংশ যার এক প্রান্ত উঠে যায় এবং যার পাশে হাত দিয়ে ধরার নির্দিষ্ট খুটি থাকে এটা পা দিয়ে চাপ দিতে আবার ছাড়তে হয়। অপরজন থাকেন নির্দিষ্ট গর্তে যেখানে আঘাতে চাল থেকে ধান বের হয় সেখানে সতর্কতার সাথে ধান দিতে হয় আবার প্রতি আঘাতের পর পর ধান নড়াচড়া করে উল্টে পাল্টে দিতে হয় যাতে সবগুলোতে আঘাত লাগে।


ইঁদারা বা পাতকুয়া-
বহু প্রাচীন বাড়িগুলিতে আজও দেখা পাওয়া যায় মজে যাওয়া কুয়া বা ইঁদারার। আজকালকার ছেলেমেয়েরা সেসব হয়তো টম এ্যান্ড জেরীর কার্টুনে জেরীকে কুয়া থেকে দড়ি দিয়ে টমের টেনে তুলবার দৃশ্য ছাড়া আর কোথাও দেখেইনা। প্রাচীনকালে মানুষ যখন ডোবা ও নদীর অপরিশুদ্ধ পানি পান করতো তখনকার বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণাকার্য সম্পন্ন করে কূপের জন্ম দেন। জমিদাররা ইঁদারাথেকে প্রাপ্ত পানিকে আরও পরিশুদ্ধ করতে ইঁদারার মধ্যে পাইপ লাগিয়ে পানি উত্তোলন করতো। এই কারনেই পুরানো জমিদার বাড়িতে বহু পুরোনো কুয়ার দেখা আজও মিলে। পর্যায়ক্রমে মানুষ যখন সভ্য, সুশিক্ষিত ও জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধশালী হলো তখন নলকূপের সৃষ্টি হলো। সংস্কৃত ইন্দ্রাগার শব্দটি ইন্দ্র ও আগার থেকে এসেছে। ইন্দ্র অর্থ বৃহৎ এবং আগার অর্থ পাত্র অর্থাৎ ইন্দ্রাগার শব্দের অর্থ হলো বৃহৎ কূপ।


ও মাঝি নাও ছাইড়া দে, ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে -পাল তোলা নাও বা পালের নৌকা-
পালের নৌকা বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম একটি নাম। শরৎকালে অমল ধবল পালে মৃদুমন্দ হাওয়ার খেলা দেখেই কবিগুরু লিখেছিলেন অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া। আগের দিনে ছোট বড় সবধরনের নৌকাতেই পাল ব্যবহার করা হত। মূলত মাঝিরা যখন দাড় টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে যেত বা বাতাস অনুকূল থাকলে পাল তুলে খুব তাড়াতাড়ি এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় যাওয়া আসা করতো। তবে বর্তমানে প্রত্যেক নৌকায় পালের যায়গা দখল করেছে মেশিন।


পালকী চলে দুলকী তালে- পালকী
পালকি আগে অভিজাত শ্রেণীর চলাচলের জন্য বিশেষ করে মেয়েদের যাতায়তের জন্য ব্যবহার করা হত। তবে বর-কনের পরিবহণ করতে এই বিশেষ যানটির ব্যবহার উল্লেখ যোগ্য। বাঁশ, কাঠ, টিন ও লোহার শিক দিয়ে তৈরি পালকি খুব দৃষ্টিনন্দন ও শিল্প সমৃদ্ধ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছয়জন বেহারা পালকি বহন করত। সেকালে পালকি ছাড়া বিয়ের সুন্দর আয়োজনটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যেত। আজ যান্ত্রিক সভ্যতায় যন্ত্রের পরিবহণ ব্যবস্থার কাছে হারিয়ে গেছে পালকি।
ডুলি
বাঁশ ও পাটের দড়ি দিয়ে নির্মিত এক প্রকার ঝুলন্ত আরামদায়ক পরিবহণ। ডুলি দু জন বেহারা কাঁধে করে বহন করত। গ্রামের নববধূরা বাবার বাড়ি নায়র করতে যেতে বা বাবার বাড়ি হতে স্বামীবাড়ি যেত ডুলিতে চড়ে। বিয়ের দিন কনের সহযাত্রী বা আচল-দি হয়ে কনের নানী বা দাদী ডুলিতে চড়ে বরের বাড়ি আসতো। আজ আর নেই সেই বেহারা আর ডুলি। সব কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।


আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে বা গাড়িয়াল ভাই এর সেই গরুগাড়ি
শুধু বউ নিয়ে যাবার জন্যই গরুর গাড়ির ব্যাবহার নয়। গ্রামবাংলার সবচাইতে প্রচলিত যানবাহন এই গরুর গাড়ি। গরুর গাড়ি বাঁশ ও কাঠ দ্বারা তৈরি হয়। গাড়িতে ছই আর মত ছাওনি দিয়ে একে সাজানো হয়।এছাড়া এককালে গ্রামের যে কোন পণ্য পরিবহণে ব্যবহার হত গরুর গাড়ি।


জসিমুদ্দিনের নকশী কাঁথার মাঠ বা বাংলার নকশিকাঁথা-
নকশীকাঁথা বাংলার ঐতিহ্য। পাখি, ফুল, লতা পাতা ও বিভিন্ন চিত্র একে মেয়েরা এককালে এক প্রকার আকর্ষণীয় কাঁথা তৈরি করতো। এতে ফুটে উঠতো গ্রাম বাংলার দৈনন্দিন জীবনের চিত্র। সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার গল্প। এই বিশেষ কাঁথাকে বলা হত নকশী কাঁথা। নকশীকাঁথা সেলাই করা একদিকে যেমন মেয়েদের শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় বহন করত, তেমনি অবসর কাটানোর একটি মাধ্যম এই নকশীকাঁথা। সে সময় এটি ছিল শীত নিবারণে গরীবদের অনন্য বন্ধু কিন্তু আজ এই নকশীকাঁথা ধনীদের বিলাস পণ্যে পরিণত হয়েছে। যদিও এটি পাওয়া খুব কঠিন তবে আড়ং বাংলার মেলায় উচ্চমূল্যে পাওয়া যায় নক্সিকাঁথা।


খেজুর পাতার পাটি -
এক সময় গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে ব্যবহার করা হতো খেজুর পাতার পাটি । কিন্তু বর্তমানে আধুনিকতার ছেয়ায় তা আর কোন বাড়ীতে বলতে গেলে এই পাটি আর দেখাই যায়না। গ্রামের নিন্ম বিত্ত ও উচ্চ বিত্ত সব পরিবারের মহিলারা তাদের ঘরে শোবার জন্য বিশেষ করে গরমকালে ব্যাবহার করতো এই পাটি। এটি আর একটি গ্রামীণ ঐতিহ্যের অংশ। এ ছাড়া হাজার রকম কাজে এটি ব্যবহার করা হয়।


খড়ম
খড়ম এক ধরণের স্যান্ডেল। খড়ম তৈরী হয় কাঠ দিয়ে । যার এক টুকরো কাঁঠের মাথায় লাগানো থাকে গোলাকার অংশ । বুড়ো আঙ্গুল আর মধ্যমা দিয়ে খড়ম পরতে হয়। বর্তমানে খড়ম ব্যবহার দেখায়ই যায়না।
ভাগ্যে শিকা ছেড়া ও গ্রামবাংলার শিকা-
শিকা গ্রাম বাংলায় গ্রামীণ বধূদের নিপুণ হস্তশিল্পের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। শিকার ছিল বহুমুখী ব্যবহার। পল্লী বধূরা শিকায় ঝুলিয়ে রাখতো সংসারের বিভিন্ন জিনিস। মাঝে মাঝে রঙিন শিকেয় ঘরের মাঝে নতুন হাঁড়িপাতিল ও অন্যান্য জিনিস সারি সারি ভাবে ঝুলিয়ে রাখতো। বর্তমানে শিকার প্রচলন নেই বললেই চলে।


হুক্কা
হুক্কা গ্রাম বাংলার অতি প্রাচীন একটি ঐতিহ্য। এটি গ্রামীণ কৃষক থেকে শুরু করে বিত্তবান মানুষের কাছেও অতি পরিচিত ও অবসর কাটানোর মাধ্যম। কাজের ফাঁকে বা গল্প গুজবের মাঝে বা অবসরে ধূমপান করার বিশেষ একটি মাধ্যম হুকা। হুক্কা ২ ধরনের দেখা যেত পিতলের বা রুপার তৈরি আর নারিকেলের মালার মালার সঙ্গে কাঠের দণ্ডের হুক্কা। বিত্তবান ও অভিজাত শ্রেণীরা ব্যবহার করতেন পিতল বা রুপার তৈরি হুক্কা আর নিন্মবিত্ত বা মধ্যবিত্তরা ধূমপায়ীরা ব্যবহার করতেন নারিকেলের হুক্কা।


মাটির হাঁড়ি পাতিল-
এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরী করা হয় মাটির হাড়ি পাতিল কড়াই। মাটি দিয়ে তৈরী শিল্পকে মৃৎশিল্প বলে। আর মৃৎশিল্পের কারিগরকে বলা হয় কুমোর। রান্না বান্না ও গৃহস্থালীকাজে ব্যাবহার হয় মাটির হাড়ি পাতিল তৈজসপত্র।
শখের হাড়ি- নক্সাদার সৌখিন হাড়ি বা নক্সীহাড়ি। এতে শখের জিনিষ তুলে রাখা হয় বা সাজানো হয়।


মাটির পুতুল বা টেপা পুতুল-
মাটি দিয়ে টিপে টিপে বানানো হয় বলেই এই পুতুলের নাম টেপা পুতুল। কিন্তু এই টেপা পুতুল বা মাটির পুতুল গ্রাম বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য। গ্রামের মেলায় বা হাঁটেও পাওয়া যেত এইসব পুতুল। আজকাল চারুকলায় বা বাংলা গ্রামীন ঐতিহ্যের দোকানগুলোতে দেখা মেলে এইসব টেপা পুতুলের।


কুড়েঘর- শনের ঘর বা মাটির ঘর-
আমরা সবাই গ্রামের ছবি এঁকেছি আর এই ছবি আঁকতে গেলে প্রথমেই যেই বিষয়টি অতি অবশ্য মাথাতে আসবেই সেটা একখানি কুড়েঘর আর তার পাশে গাছ পালা নদী। সে মাটি দিয়ে বা ছন দিয়ে ছাওয়া। আমাদের বাংলাদেশের এক অতি
পরিচিত ছবি যেন এই কুড়েঘর। কুড়ে ঘর ছাড়া বাংলাদেশের গ্রাম ও প্রকৃতি অসম্পূর্ণ।


লাঙ্গল জোয়াল
কালের বিবর্তনে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান বাংলার কৃষি কাজে ব্যবহৃত লাঙ্গল, জোয়াল,মই। কৃষিপ্রধান আমাদের দেশে এক সময় খেতে-খামারে কৃষকের লাঙ্গল আর মই দিয়ে চাষাবাদের দৃশ্য সবার নজর কাড়তো। চাষাবাদের অন্যতম উপকরণ হিসেবে কাঠের লাঙ্গল ছিল অপরিহার্য। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী চাষাবাদে বহুল ব্যবহৃত বাঁশ,কাঠের হাতল ও লোহার ফাল বিশিষ্ট কাঠের লাঙ্গল আজ বিলুপ্তির পথে। এক সময় কাঠের লাঙ্গল ছাড়া গ্রাম বাংলায় চাষাবাদের কথা চিন্তাই করা যেত না কিন্তু কালের বিবর্তনে বিজ্ঞানের যুগে পদার্পণ করে চাষাবাদের যান্ত্রিক সব সরঞ্জামাদি ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে কৃষি কাজে ব্যবহৃত ওইসব লাঙ্গল, জোয়াল, মই ও হালের বলদ।


কুপি
যখন গ্রাম বাংলার গৃহে গৃহে ইলেক্ট্রিসিটি পৌছোয়নি তখন সন্ধ্যা বা সাঁঝের পর কুপির আলো ছাড়া আর কোনো পথ ছিলোনা। সেই অতি প্রয়োজনীয় কৃপি আজ বিলীন হওয়ার পথে।
একটা সময় ছিল যখন বাহারি ধরনের কুপিই ছিল মানুষের অন্ধকার নিবারণের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু কালের গহবরে কুপি বাতির স্থান দখল করে নিয়েছে বৈদ্যুতিক বাল্ব, চার্জার, হ্যারিকেনসহ আরো অনেক কিছুই। ফলে ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় এই নিদর্শনটিও। কুপিগুলি ছিলো নানা ধরণের।কোনটি ছিল মাটির, কোনটি লোহার, কোনটি কাঁচের আবার কোনটি ছিল পিতলের তৈরী।


যাতা
একসময় গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ীতে দেখা যেত জাতা। জাতা দিয়ে ভাঙ্গা হতো মশুরী, খেসারী, মাশ কলাইসহ নানা রকমের ডাল। পাথরের তৈরী যাতা এখন আর চোখে পড়ে না সচরাচার।


লাল টুকটুকে বউ যায় লো লাল নটের ক্ষেতে, তার আলতা পায়ের চিহ্ন এঁকে - আলতা
আলতা দিয়ে এককালে মেয়েরা তাদের হাত, ঠোঁট, গাল ও পা রাঙ্গাতে। বিয়ের বাজারে লালএই আলতার নাম থকতো সবার উপরে। নববঁধু বা বাড়ির বঁধুর পা আলতা দিয়ে মোড়ানো ছিলো যেন গ্রাম বাংলার গৃহস্থ বাড়ির এক অপার সৌন্দর্য্য।


আমার বাড়ি যাইও ভ্রমন বসতে দেবো পিড়ে- বাঙ্গালীর পিড়ি-
বাড়ির মেহমান এলে বা বাড়ির বিভিন্ন কাজে বা কোথাও বসতে যে জিনিসটি এখনো গ্রামের মহিলারা ব্যবহার করে তা হল এই পিড়ি। এটি আগে তৈরি করা হত মাটি দিয়ে ও কাঠ দিয়ে।


মাথাল বা মাথল
গ্রামীণ কৃষকেরা বর্ষা বা গ্রীস্মে বৃষ্টি ও প্রখর রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় দেয় এই মাথাল। বাঁশ ও শাল পাতার সাহায্যে এটি প্রস্তুত করা হয়।


বাবুই পাখিরে ডাকি কহিছে চড়াই- শিল্পী বাবুইয়ের বাসা
বাংলার ঐতিহ্যবাহী নিপুণ বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখি।এ পাখি সুনিপুণভাবে খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা, ঝাউ কাঁশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু তালগাছ নারিকেল গাছে চমৎকার আকৃতির বাসা তৈরি করে। বাবুই পাখির বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি মজবুত।প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রবল ঝড়ে বাতাসের সাথে মোকাবিলা করে টিকে থাকে তাদের বাসা। মুক্ত বুননের বাবুই পাখির বাসাটি টেনেও ছেঁড়া খুব কঠিন। বাবুই এক ধারে শিল্পী, স্থপতি এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি।


তার পরেতে দেখা গেল, গাঁয়ের বধূ নাইয়র এলো - বাংলার বায়োস্কোপ-
এককালে ছেলেবুড়ো থেকে শুরু করে গ্রামের প্রায় সকলেই মুখিয়ে থাকত বায়স্কোপ দেখার জন্য। সবাই মিলে দেখতো একটা বাক্সের মধ্যে সুন্দর করে পোষ্টার ছবি সাজানো বায়োস্কোপ। গ্রামের শিশুরা ছুটতো তার পেছনে পেছনে।হাতে থাকতো তার ঢুগঢুগি। বাক্সের চারখান ফুটোয় আট জোড়া চোখ লাগিয়ে সেই স্বপ্নের সিনেমা দেখতো গাঁও গেরামের মানুষ। এসব বায়স্কোপ এ থাকত মিথ, প্রেম কাহিনী থেকে শুরু করে বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ পর্যন্ত।
বাংলার লাঠিয়ালদের কথা-
কবি জসীম উদ্দিন তার সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্যে ও আগের দিনে নানা কাব্য গল্প বা উপন্যাসে দেখা পাওয়া যায় লাঠিয়ালদের। জমিদারপ্রথায় লাঠিয়াল ছাড়া ছিলো জমিদারি প্রায় অচল। যেকোনো কাইজা বিবাদ জোর জবরদখলে বা খাজনা উত্তলনে লাঠিয়ালদের ভুমিকা ছিলো মুখ্য।


পুঁথি ও পুঁথিপাঠ-
বাংলার সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বকীয়তা রয়েছে তার বড় একটি প্রমাণ নাগরী পুঁথি সাহিত্য। কয়েকশ বছর আগে ভাষাটি সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও টিকে আছে তার কিছু ইতিহাস, দলিল বা পুঁথি। কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা এবং আসামের কিছু অঞ্চলে এর ব্যবহার ছিল। সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে এ বর্ণমালাটি বিলুপ্ত হতে চলেছে। চর্চা ও রক্ষণাক্ষেণের অভাবেই বলা চলে নাগরীলিপির উৎপত্তি ও বিস্তার নিয়ে নানা মতপার্থক্য থাকলেও এটির সংরক্ষণ একটি সিদ্ধান্তে পৌছতে সাহায্য করবে। বিলুপ্তপ্রায় দুর্লভ এ লিপিসংবলিত কিছু পুঁথি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছে, যা হারিয়ে যাওয়া সাহিত্যের বিশাল একদিককে আবারও পাঠক আগ্রহী করে তুলতে পারে। কেতাব হালাতুন্নবী, আদি বড় জঙ্গনামা, ছহি বড় আছরার ছালাত, গাজী-কালু, সোনাভান পুঁথি সাহিত্যের কিছু নাম।


বাবু সেলাম বারে বার আমার নামটি গয়া বাইদ্যা বাবু - সাপের খেলা –
সাপখেলা দেখায় বেদেরা। বেদেদের মধ্যে সাপুড়ে, সওদাগর ও লোকচিকিৎসক নামে তিন ধরনের পেশাজীবী রয়েছেন। যার মধ্যে প্রধানতম পেশাজীবী হচ্ছেন সাপুড়ে- যাদের কেউ কেউ শুধু সাপ ধরে সাপ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কেউ-বা আবার আকর্ষণীয় সাপগুলোকে বিভিন্ন কৌশলে বশ করে খেলার উপযোগী করে তোলেন। এবং সেই সাপগুলোকে ঝুড়িতে ঢুকিয়ে বাকে ঝুলিয়ে বা মাথায় করে গ্রামে গ্রামে, হাটে বাজারে ফেরি করে বেড়ান। আর সুবিধামতো স্থানে সাপ খেলার আসর জমিয়ে দেন। সেই আসরে তারা একই সঙ্গে সাপ খেলা দেখিয়ে এবং কিছু লোকচিকিৎসার গাছ-গাছড়া ও কবিরাজি ঔষধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
সাপ খেলা দেখানোর উপাদান ও উপকরণ হিসেবে সাপুড়েরা সাধারণত লাঠি, বীণ বা বাঁশি, বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছড়া ব্যবহার করে থাকেন। সে সকল সাপ ফণা তুলতে পারে সে সকল সাপই খেলা দেখানোর প্রধান সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গোখরা সাপই সাপুড়েদের প্রধান অবলম্বন।
সাপ খেলা দেখানোর সময় সাপুড়ের হাতের ও শরীরের বিভিন্ন ভঙ্গি করে। সাপকে নিয়ন্ত্রণ করা ও দর্শককে আকৃষ্ট করে আসরে দাঁড় করিয়ে রাখা এই তাদের উদ্দেশ্য।


বানর খেলা -
বাংলাদেশের শহর ও গ্রাম দুটি ক্ষেত্রে মাঝে মাঝেই বানর খেলা দেখা যায়। বাংলাদেশের বেদে বা যাযাবরসহ সাধারণ মানুষের মধ্যেও কেউ কেউ পেশাগতভাবে বানর পোষেন। তারা মাঝে মাঝে চাল বা অর্থ সংগ্রহের জন্য গ্রামে গঞ্জে, শহর-বাজারে বানর খেলা করায়ে থাকেন। বানর খেলার সময়ে ক্ষেত্র বিশেষে বানর খেলোয়াড়গণ বানরকে চমৎকার ঘাগরা পরিয়ে সাজিয়ে নিয়ে এই বানর খেলা দেখিয়ে থাকেন।


নৌকা বাইচ
নৌকাবাইচ হলো নদীতে নৌকা চালনার প্রতিযোগিতা। একদল মাঝি নিয়ে একেকটি দল গঠিত হয়। এমন অনেকগুলো দলের মধ্যে নৌকা চালনা প্রতিযোগিতাই হল নৌকা বাইচ। ফার্সি শব্দ বাইচ এর অর্থ বাজি বা খেলা। নৌকার দাঁড় টানা ও নৌকা চালনার কৌশল দিয়ে প্রতিযোগীরা জয়ের জন্য খেলেন বা বাজি ধরেন। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আনন্দ আয়োজন, উৎসব ও খেলাধুলা সবকিছুতেই নদী ও নৌকার সরব আনাগোনা। হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংস্করণ বাংলাদেশের নৌকা বাইচ। এক সময় এ দেশে যোগাযোগ ছিল নদী কেন্দ্রিক আর বাহন ছিল নৌকা।
শন পাপড়ি- ছেলেবেলায় বুড়ির মাথার পাকা চুল বা শনপাপড়িওয়ালা দেখে ছুটে যায়নি এমন কেউ কি এই দুনিয়ায় আছে? গ্রামাঞ্চলে নেই কে এফ সি বা পিজ্জা কিন্তু এসব খাবারের আবেদনও বুঝি শনপাপড়ির কাছে কিছুতেই লাগেনা।
আচার - নানা রকম আচার আমের আঁচার, কুলের আচার, চালতা বা তেঁতুলের আঁচার. এসব যখন সুনিপুন হাতে বানিয়ে রোদে শুকুতে দেয় গাঁয়ের বৌ ঝিয়েরা। তখন সেই বোতল বা গামলা থেকে একটু খানি লোভনীয় আচার চুরির লোভ সামলানো বড়ই মুসকিল।


আমসত্ব - পাকা আমের রস গুলিয়ে পরিষ্কার চাটাই এ শুকিয়ে বানানো হয় আমসত্ব। আমার ধারনা বেহেস্তের অমৃত খেতেও বুঝি আমসত্বের চাইতে কম মজার।


কুমড়ো বড়ি- গ্রাম বাংলার একটি অতি পরিচিত খাদ্য কুমড়োবড়ি। চালকুমড়ো কুরিয়ে আর মাসকালাই এর ডালে রোদে শুকিয়েতৈরী হয় কুমড়ো বড়ি।যা ভর্তা, চচ্চড়ি ও নানা প্রকার মাছের ঝোলেও রান্না করা হয়।


বাতাসা- চিনির তৈরী মিষ্টান্ন যার ভেতরটা বাতাসে ফুলানো হয় বলেই এই খাবারটির নাম বাতাসা। গ্রামের মেলা বা হাঁটে এটি একটি চির পরিচিত অতি আদরনীয় খাদ্য হিসেবেই পাওয়া যায়।
মোয়া- মুড়ি আর গুড়ে গোল গোল করে গড়া হয় মোয়া। শিশু হতে শুরু করে ছেলে বুড়ো সকলেরই অতি প্রিয় এই মোয়া। মোয়া মুড়ি চাড়াও চিড়ে দিয়েও তৈরী হয়ে থাকে।


গজা -খরগজা , জিবেগজা বা মুরলী আরও একটি মিষ্টি শুকনো খাবার। লম্বা ছোট লাঠির গায়ে লেগে থাকা চিনিগোলা হাল্কা মিষ্টির এ খাবারটিও বাংলার এক ঐতিহ্য।


কদমা- ধবধপে সাদা গোল এই শুকনো মিষ্টির সাথে কদম ফুলের কোনো সাদৃশ্য আছে বলেই কিনা জানিনা এর নাম কদমা কিনা। তবুও কদমা নামে এই মিষ্টিটি ছেলেবুড়ো সকলের প্রিয়।


হাওয়াই মিঠা বা ক্যান্ডিফ্লস-
মনহরণকারী রঙে ও অদ্ভুত স্বাদ ও জিভে ছোঁয়ামাত্র মিলিয়ে যাওয়া মজার এই খাদ্যটি যে কোনো শিশুর হৃদয়ে চিরস্থায়ী এক ভালো লাগা গেঁথে রাখে।
গ্রামাঞ্চলের হাওয়াইমিঠা পসারীরা ছোট ছোট গোলাকারে কাঁচের বাক্সে ফেরি করেন এই হাওয়াই মিঠা।
নাড়ু- নারকেলের কোরা, তিল বা চিড়ে দিয়ে তৈরী বাংলার এ সুস্বাদু খাবারটি নানা পূজা পার্বন হতে শুরু করে গ্রামের প্রতিটি উৎসব অনুষ্ঠানেই তৈরী করা হয়।

তথ্যসূত্র:
১। বৈশাখ ও আমাদের ঐতিহ্যচেতনা - তিতাস চৌধুরী
২.বৈশাখ, লোককৃতি কথাগুচ্ছ, আতোয়ার রহমান
৩। রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশের সূচনা, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
৪। বৈশাখ ছায়ানট
http://www.businesstimes24.com/?p=35239

ছবিঃ নেট থেকে।


বাংলা নতুন বছর উপলক্ষে আমার এ লেখাটির উদ্দেশ্য গ্রাম বাংলার কিছু চিরায়ত নিদর্শনের সাথে আমাদের নতুন প্রজন্মের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের ছেলেমেয়েরা এসবের অনেক কিছুই জানেনা। আমার এ লেখায় আরও শত শত প্রায় হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার স্মৃতিময় সৌন্দর্য্য বাদ পড়ে গেছে। যারা লেখাটি পড়বেন তারা যদি এমন কিছু যোগ করে দিতে পারেন তবে আমার এ লেখাটি আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে ও আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।

সকলকে বাংলা নতুন বছর ১৪২২ এর শুভেচ্ছা।

সোর্স ঃ http://beta.somewhereinblog.net/blog/Shyry/30030164

No comments:

Blogger Widgets